মালিকুজ্জামান কাকা: নাগরিক উদ্বেগ যশোরের গৌরব ভৈরব নদ। তার সংস্কার আন্দোলনের পক্ষ থেকে বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজাহারুল ইসলামের নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে।
স্মারকলিপিতে নদী রক্ষায় আট দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে উজানে দ্রুত নদী সংযোগ স্থাপন,ভৈরবসহ সকল নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে সীমানা ফিরিয়ে দেওয়া, নদীর সীমানার ভেতরের স্থাপনা উচ্ছেদ ও দখলদারদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, নদী তট আইন মেনে সীমানা নির্ধারণ,
আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী দাইতলা, ছাতিয়ানতলা ও রাজারহাটের সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করা,দাইতলা ও ছাতিয়ানতলার অস্থায়ী সেতু তাৎক্ষণিকভাবে চলাচলের উপযোগী করা, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও বাজারের বর্জ্য নদীতে ফেলা বন্ধ করে নদীর পরিবেশ পুনরুদ্ধার, নৌ ভ্রমণ ও নদী পাড়ে হাঁটার জন্য ফুটপাত নির্মাণ, মুক্তেশ্বরীর বুক থেকে আদ দ্বীন উচ্ছেদ এবং নদী ভরাট করে প্লট বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
একইসাথে আন্দোলনের পক্ষ থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এতে বলা হয়, আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করা ও অস্থায়ী সেতুর মেরামতের দাবিতে নির্বাহী প্রকৌশলী এলজিইডির নিকট স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। দাবি পূরণ না হলে অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যশোর-ঢাকা মহাসড়কে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হবে।
স্মারকলিপিতে সংগঠনের আহ্বায়ক প্রফেসর আফসার আলীর স্বাক্ষর ছিল। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জিল্লুর রহমান ভিটু, তসলিম উর রহমান, আবু হাসান, হারুন অর রশিদ, হাচিনুর রহমান, এডভোকেট মাহমুদ হাসান বুলু, রাসেদ খান, শেখ আলাউদ্দিন, সাহবুদ্দিন বাটুল, রায়হান বিশ্বাস প্রমুখ।
যশোরের ভৈরব নদ। মেহেরপুর সীমান্ত থেকে উৎপন্ন হয়ে যশোর শহর ও এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এটি নওয়াপাড়া শিল্প শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত। এই নদ দিয়ে প্রতিনিয়ত মালামাল আনা নেওয়া করা হয়। তবে, অপরিকল্পিত সেতু ও দখলদারিত্বে নদীটি বর্তমানে সংকীর্ণ হয়ে গেছে এবং এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীর উৎস ও গতিপথ: ভৈরব নদ মেহেরপুর জেলার টেঙ্গামারী সীমান্ত থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এটি যশোর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। যশোর-খুলনা মহাসড়কের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে ভৈরব নদ বয়ে গেছে।
নদীর গুরুত্ব ও ব্যবহার: যশোর ও খুলনা অঞ্চলের এটি একটি দীর্ঘতম নদী। নদীর তীরে নওয়াপাড়া শিল্প শহর অবস্থিত। এই নদীতে জাহাজ বা কার্গোর মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার মালামাল পরিবহন করা হয়, যা বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহন করে।
জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খনন করা হয়েছে যশোরের ভৈরব নদ। এতে ব্যয় হয়েছে ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে খননের আগে নদটি পাড়সহ ছিল ২৬৩ ফুট। খননের পর এখন ১০০ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নদের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত ৫২টি সেতুর কারণে ভৈরব নদের নৌ-যোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে
জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় খনন করা হয়েছে যশোরের ভৈরব নদ। এতে ব্যয় হয়েছে ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। তবে খননের আগে নদটি পাড়সহ ছিল ২৬৩ ফুট। খননের পর এখন ১০০ ফুটে এসে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া নদের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত ৫২টি সেতুর কারণে ভৈরব নদের নৌ-যোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন নদী বিশেষজ্ঞরা।
ভৈরবের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অদূরদর্শিতাকেই দায়ী করছেন তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, ভৈরব নদের জলাবদ্ধতা নিরসন ও পানিপ্রবাহ নির্বিঘ্ন করতে ২০১৬ সালে একটি প্রকল্প হাতে নেয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৭২ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নদ খননকাজ শুরু হয় ওই বছরের ১ জুলাই। পরে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
তখন ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৭৯ কোটি ১২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। প্রকল্পের আওতায় চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে সদর উপজেলার বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার নদ পুনঃখনন হয়েছে। এছাড়া বসুন্দিয়া থেকে আফ্রা ঘাট পর্যন্ত চার কিলোমিটার নদ ড্রেজিং করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় শহরের প্রাণকেন্দ্র ভৈরব নদের তীরে ৭ কোটি ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০০ মিটার এলাকা সৌন্দর্যবর্ধনের কাজও করা হয়েছে।
তবে নদের ওপর নির্মিত ৫২টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১৬ দশমিক ৪ থেকে ১২০ ফুটের মধ্যে। একটি মাত্র সেতুর দৈর্ঘ্য ১৭৭ দশমিক ১১২ ফুট। অথচ নদের প্রশস্ততা ১৫০-২৫০ ফুট। এ কারণে নৌ-যোগাযোগ স্থাপন এবং জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা যাচ্ছে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০২৩সালের ২ ফ্রেব্রুয়ারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, ভৈরব নদের ওপর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের ২৩টি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তরের ১৯টি, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের তিনটি, সড়ক ও জনপথের পাঁচটি, রেলওয়ে ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের একটি করে সরু সেতু রয়েছে। এসব সেতুর কারণে নৌ-যোগাযোগ স্থাপনসহ জোয়ার-ভাটা প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা সম্ভব হচ্ছে না
এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী জানান, ‘সঠিকভাবে ভৈরব নদ খনন করা হয়েছে। কিন্তু নদের ওপর নির্মিত অপ্রশস্ত ৫২টি সেতুর কারণে জোয়ার আসছে না। সেতুগুলো অপসারণ করে নদের প্রশস্ততা অনুযায়ী পুনর্নির্মাণে সেতু সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোয় চিঠি দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দপ্তরগুলোর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নদটি কচুরিপানায় ভরে আছে। সেতুগুলোর তলায় অনেক মাটি রয়েছে। নদ দিয়ে যাতে জোয়ার আসতে পারে সেজন্য বর্ষা মৌসুমের আগে কচুরিপানা এবং সেতুর নিচের মাটি অপসারণ করার কথা ছিল।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার মুরটি গ্রামে পদ্মার শাখা জলঙ্গি থেকে ভৈরব নদের উৎপত্তি। মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে নদীটি। চুয়াডাঙ্গার দর্শনা, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর, যশোরের তাহেরপুর, আফ্রা ও অভয়নগর এবং খুলনার ফুলতলা, দীঘলিয়া ও দৌলতপুর হয়ে খুলনা নগরীর কাস্টম ঘাট এলাকায় ভৈরব মিশেছে রূপসা নদীতে।
চৌগাছার তাহেরপুরে কপোতাক্ষের উৎসমুখ থেকে খুলনার রূপসা-ভৈরবের মিলনস্থল পর্যন্ত ভৈরবের মোট দৈর্ঘ্য ১৩৩ কিলোমিটার। এর মধ্যে রূপসা-ভৈরবের সঙ্গমস্থল থেকে যশোরের বসুন্দিয়া পর্যন্ত ৪১ কিলোমিটার প্রবহমান। আর বসুন্দিয়া থেকে সদর উপজেলার রূপদিয়া পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার ক্ষীণধারায় প্রবহমান। সেখান থেকে চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুরের কপোতাক্ষের উৎসমুখ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার প্রবাহহীন।
বর্তমান অবস্থা: অপরিকল্পিত সেতু নির্মাণ এবং দখলদারিত্বের কারণে ভৈরব নদটি বর্তমানে সংকীর্ণ হয়ে গেছে। নদের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এর নৌ-যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা দূরীকরণে নদীটি খনন করা হলেও, অপরিকল্পিত সেতুগুলো এর কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়েছে।
আরও পড়ুন ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজে নবীন বরণ
Leave a Reply