নিজস্ব প্রতিনিধি তারিকুল ইসলাম তারাঃ বৈশাখ মাস পড়তেই উত্তরের নদীবিধৌত জনপদগুলো যেন এক নীরব সংকটের মুখে পড়ে। নদী শুকিয়ে যায়, বড় বড় নদীর বুকেও নেমে আসে হাঁটুজল। রৌদ্রের প্রখরতা, তপ্ত বাতাস আর শুষ্ক আবহাওয়ার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় গ্রামের মানুষের বৈশাখী জীবনযাত্রা। কিন্তু কুড়িগ্রামের চরাঞ্চলগুলো—বিশেষ করে রাজিবপুর ও রৌমারী উপজেলার মানুষের জন্য এ সময়টা কেবল মৌসুম নয়, বরং লড়াইয়ের আরেকটি অধ্যায়।
রাজিবপুর উপজেলার কোদালকাটি ও মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের মানুষ প্রতি বছর বৈশাখ থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত উপজেলা সদরের সঙ্গে কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাকা বা কাঁচা রাস্তা তো নেই-ই, বর্ষার পানি নামলেও নদী-খাল পার হওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া আর কোনো ভরসা থাকে না। হাট-বাজার, স্কুল, হাসপাতাল—সবকিছুর সঙ্গে যোগাযোগে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির শিকার হন এখানকার বাসিন্দারা।
এলাকাবাসীর ভাষ্যমতে, অসুস্থ হলে রোগীকে সদর হাসপাতালে নেওয়া রীতিমতো এক যুদ্ধ। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে দুর্ভোগ ভয়াবহ রূপ নেয়। অনেক সময় দেখা যায়, প্রসববেদনায় কাতর নারীকে নৌকায় তোলা হয়, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই নদীপথেই সন্তান জন্ম নিচ্ছে। এর ফলে জটিলতা দেখা দেয়, জীবন হুমকিতে পড়ে মায়েরও, শিশুরও।
বিগত শাসনামলে রাজিবপুরের বিভিন্ন চরে কাঠের ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছিল। এলাকাবাসী জানান, একটি ব্রিজের জন্য বরাদ্দ ছিল ১২ লাখ টাকা। কিন্তু নির্মাণকাজে ব্যবহৃত হয় নিম্নমানের কাঠ। ঠিকাদারদের দুর্নীতি ও নিম্নমানের কাজের কারণে ব্রিজগুলো এক বছরের মধ্যে ভেঙে পড়তে শুরু করে। এখন অনেক ব্রিজই কার্যত অকেজো। ফলে বর্ষা মৌসুমে মানুষ পায়ে হেঁটে যেতেও পারে না, আর শুকনা মৌসুমেও রয়ে যায় বিচ্ছিন্নতা।
তবে বৈশাখের নদীর হাঁটুজল কেবল দুর্ভোগের প্রতীক নয়। গ্রামীণ শিশুরা এই সময় নদীতে নামে খেলতে, দল বেঁধে কাদামাখা শরীরে হাঁটুজলে ছুটে বেড়ায়, ছোট মাছ ধরে। তারা জানে না উন্নয়ন, জানে না দুর্নীতি—তাদের কাছে বৈশাখ মানে মজা আর নদীর খেলা।
বৈশাখের নদী শান্ত, সংযত—বর্ষার প্রবাহ আর দাপট এখানে অনুপস্থিত। এই হাঁটুজলের নদী যেন প্রকৃতির এক গভীর নিশ্বাস ফেলা। কিন্তু এই সৌন্দর্যের মাঝেই চরাঞ্চলের মানুষের জীবনে জমে থাকে কষ্টের ছায়া। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবার প্রসার আর দুর্নীতিমুক্ত অবকাঠামো নির্মাণ—এই তিনটি দাবিই চরবাসীর মুখে মুখে ঘুরে ফিরে।
প্রতি বছরই সরকার চরাঞ্চলের উন্নয়নের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতায় রাজিবপুর-রৌমারীর মানুষ হাঁটুজল পেরিয়েও পৌঁছাতে পারে না শহরের মূলস্রোতে। উন্নয়নের জোয়ার কবে তাদের ঘরে পৌঁছাবে, তা আজও এক বড় প্রশ্ন।
আরও পড়ুনঃ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহামুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবীতে মানববন্ধন
Leave a Reply