মালিকুজ্জামান কাকা
যশোরের ভবদহ এলাকার দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসনে এবার নতুন আশার আলো দেখছেন ভুক্তভুগি স্থানীয়রা। ২২ এপ্রিল মঙ্গলবার সকালে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা দলসহকারে ভবদহ এলাকা পরিদর্শন করেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ও স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী পরিদর্শনে অংশ নেন। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও ছিলেন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব · ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানসহ সরকারি কর্মকর্তারা এসময় উপস্থিত ছিলেন।
সকাল ১০টায় তারা হেলিকপ্টারে নওয়াপাড়া সরকারি কলেজ মাঠে পৌঁছে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে ভবদহের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখেন। এ সময় উপদেষ্টাগণ দুর্ভোগে থাকা মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন।
বর্তমান সরকার ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ,’ বলেছেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি আরও জানান, কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে এবার ধান চাষ সম্ভব হয়েছে। তবে, এখনও ৪ হাজার হেক্টর জমি জলাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে।
প্রধানত সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে নদী খননের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে, যা অতিরিক্ত পানি জমে যাওয়ার সমস্যা নিরসনে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি, সেচপাম্পের কার্যক্রম এবং বিদ্যুৎ বিল হ্রাসের বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ইতিমধ্যে ৪৬ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। কৃষি ব্যাংকেও ঋণের সুদ মওকুফের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
উপদেষ্টারা জানান, জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সরকার ইতিমধ্যে ফিজিবিলিটি স্টাডি শুরু করেছে। তারা সকল পক্ষের মতামত গ্রহণের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করছেন।
দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হবে
‘ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যা ২০০৫ সালে সহজেই সমাধান করা সম্ভব ছিল, কিন্তু সে সময় সরকারের সদিচ্ছার অভাব ছিল। বর্তমানে, সরকার সক্রিয়ভাবে জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে কাজ করছে,’ বলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তিন উপদেষ্টা একত্রে ভবদহ পরিদর্শন করেছি যাতে জাতীয় নীতিনির্ধারণী মহলে ঐক্যমত্য গড়ে তোলা যায় এবং চিরস্থায়ী সমাধান বাস্তবায়ন সম্ভব হয়।’
এছাড়া, উপদেষ্টারা ভবদহের জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে জানান, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হবে এবং সর্বোত্তম সমাধান চূড়ান্ত করা হবে।
পরিদর্শনকালে সেনাবাহিনীর প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী নির্ধারিত এলাকা ঘুরে দেখেন উপদেষ্টারা। এরপর বিকেলে যশোর জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সুধীসমাজ ও ভবদহ সংগ্রাম কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ গ্রহণ করেন।
ভবদহ এলাকার অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর (যশোর) এবং ডুমুরিয়া ও ফুলতলা (খুলনা) উপজেলার অংশে প্রতিবছর বর্ষায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীর নাব্যতা হারানোয় পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে এই দুর্ভোগ সৃষ্টি।
স্থানীয়দের অভিযোগ, গত চার দশকে ৬৫০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধান হয়নি। তারা দীর্ঘদিন ধরে ‘টাইডাল রিভার ম্যানেজমেন্ট (টিআরএম)’ চালু ও আমডাঙ্গা খাল খননের দাবি জানিয়ে আসছেন।
ভবদহ সংগ্রাম কমিটির উপদেষ্টা ইকবাল কবির জাহিদ বলেন, “তিন উপদেষ্টার একসঙ্গে আগমন আমাদের দীর্ঘ আন্দোলনের বড় সাফল্য। আমডাঙ্গা খাল খননের টেন্ডার শুরু হয়েছে, টিআরএম চালু নিয়ে আশাবাদী আমরা।”
সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, “পানিনিষ্কাশনের কিছু কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। কৃষকদের ক্ষতিপূরণ ও দুর্নীতির বিচার চাই আমরা।”
তবে উপদেষ্টাদের এই গুরুত্বপূর্ণ পরিদর্শনের ঠিক আগমুহূর্তে, ভবদহে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা (টিআরএম) চালু করা নিয়ে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে মতবিরোধ দেখা যায়। টিআরএম চালুর পক্ষে এবং বিপক্ষে দুটি পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে নিজ নিজ দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে।
জানা যায়, টিআরএম চালুর দাবিতে একটি পক্ষ দ্রুত এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে, টিআরএমের বিপক্ষে থাকা বিক্ষোভকারীরা তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। তাদের দাবি, টিআরএম চালু হলে এই অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য খাত মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। জলাবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানে তারা নদী খননের ওপর জোর দিচ্ছেন।
টিআরএম বিরোধী আন্দোলন থাকা আসাদুজ্জামান বাবু ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘যারা টিআরএম প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা বলছেন, তাদের অধিকাংশই এই এলাকার ভুক্তভোগী নন। এই অঞ্চলে তাদের এক কাঠা জমিও নেই। শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা এই অযৌক্তিক দাবি করছেন।
’তবে অন্যপক্ষ বলছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ঘের বানিয়ে মাছ চাষ করে আসছেন তারাই ভবদহের জলাবদ্ধতা দীর্ঘকাল ধরে স্থানীয় জীবনযাত্রার মান এবং কৃষিকাজের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে আসছেন।
সারাংশ এই উপদেষ্টাদের এমন উদ্যোগে ভবদহবাসীর প্রত্যাশা: মিলবে কার্যকর ও টেকসই সমাধান।
Leave a Reply