মালিকুজ্জামান কাকাঃ যশোর উপশহর মাদ্রাসা। সব প্রতিবেদনেই জাকারিয়া অবৈধ হয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও উচ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তদন্ত প্রতিবেদনে জাকারিয়া সম্পূর্ণ অবৈধ অধ্যক্ষ হিসেবে প্রমানীত হওয়ায় তার নিয়োগ বাতিল ও অধ্যক্ষ হিসেবে আ ন ম আব্দুর রাজ্জাককে পূনর্বহালের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই সাথে আব্দুর রাজ্জাকের বকেয়া বেতনের বিষয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আদালতের রায় ও কয়েকটি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের পক্ষে রেজিস্টার প্রফেসর আব্দুস সাত্তার মিয়া এই নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা পাওয়ার পর যোগদানও করেছেন আব্দুর রাজ্জাক।
আর অবস্থা বেগতিক দেখে নির্দেশনার আগেই মাদ্রাসা ছেড়ে চলে গেছেন অভিযুক্ত অধ্যক্ষ জাকারিয়া হোসেন।
রাজনৈতিক রঙ লাগিয়ে প্রতিষ্ঠাতা ও জমিদাতা পরিবারের সন্তান আ ন ম আব্দুর রাজ্জাককে অধ্যক্ষ পদ থেকে বরাখাস্ত করা হয়। আর নানা অনৈতিক পন্থায় জালিয়াতিপূর্ণ কাগজপত্র উপস্থাপন করে একজন সহকারী মৌলভী জাকারিয়াকে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয় উপশহর আলিম মাদ্রসায়। অনৈতিক পন্থায় বরখাস্ত থাকা অধ্যক্ষ এবং উপশহর অঞ্চলের সচেতন মানুষ ও অভিভাবকদের অব্যাহত অভিযোগের প্রেক্ষিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি গঠন করে। তদন্তে জাকারিয়ার প্রভাষক ও পরে অধ্যক্ষ পদ দুটিই অবৈধ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই প্রতিবেদনের পরও দৌঁড়ঝাপ দেন জাকারিয়া। এখন শো’কজ ও শো’কজের উত্তর প্রদানসহ বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি চালাচালি করে কালক্ষেপণ করতে থাকেন। সাবেক সভাপতি শওকত হেসেন রত্ন জাকারিয়ার কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আব্দুর রাজ্জাককে বরখাস্ত করেন। সেই থেকে প্রায় এক যুগ আইনী লড়াই লড়ে পূনর্বহাল হয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক। তার বরখাস্তাদেশ প্রত্যাহার করে তাকে পূনর্বহাল করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জাকারিয়া হোসেনের নিয়োগ বিধিমোতাবেক না হওয়ায় তা বাতিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
নির্দেশনা পত্রে বলা হয়েছে, আরবী প্রভাষক পদেই জাকারিয়ার নিয়োগ বিধিমোতাবেক হয়নি। এরপর তিনি অধ্যক্ষ সেজে বসেন। তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসেবে এমপিও ভূক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। আ.ন.ম আব্দুর রাজ্জাক বিজ্ঞ সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে একটি মামলা ও দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেন। কয়েকটি তদন্ত কমিটির কাছে জাকারিয়া হোসেনের দেয়া কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেছে আ.ন.ম আব্দুর রাজ্জাকের বরখাস্ত ২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অনুমোদন করায় ৬টি আলোচ্যসূচি উল্লেখ করা হয়। বোর্ডের পত্রের প্রেক্ষিতে অধ্যক্ষের শূন্যপদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, বাছাই কমিটি, নিয়োগবোর্ড, বিগত সভার রেজুলেশন পঠন ও অনুমোদন ও বিবিধ বিষয়ে একই বছরের ৩ অক্টোবর গভর্নিং বডির সভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য প্রবিধানমালা-২০০৯ এর ধারা ৩৩(৪) মোতাবেক সাধারণ সভা অনুষ্ঠানের সাত দিন পূর্বে বিজ্ঞপ্তি জারি (আলোচ্য সূচিসহ) ও ধারা ৩৭ (২) এ অনুমোদনের বিধান রয়েছে। অন্যদিকে, ৩৪(১) মোতাবেক বিশেষ সভার বিধান রয়েছে, যেখানে একটির অধিক আলোচ্যসূচি থাকবে না। সে কারণে ৩ অক্টোবর গভর্নিং বডির সভা বিধি মোতাবেক হয়নি। আ.ন.ম আব্দুর রাজ্জাক তার দেওয়ানী মোকাদ্দমা প্রত্যাহার করে বোর্ডে পূনর্বহালের দাবি করেন। রিট পিটিশন নাম্বার ১০১০২/২০১৪ প্রদত্ত রায় ও রিট পিটিশন নাম্বার ৫১১৫০/২০১৯ তে আদেশে বলা হয়, আ.ন.ম আব্দুর রাজ্জাকের বরখাস্তাদেশ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন সঠিক ছিলনা।অব্যাহত জালিয়াতি ও প্রতারণামূলক কাগজপত্র উপস্থাপন করে সহকারী মৌলভী থেকে প্রভাষক ও পরে অধ্যক্ষ পদ গ্রহন করা জাকারিয়াকে শেষ পর্যন্ত অধ্যক্ষ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগের পর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর তদন্ত কমিটি করে। পরিচালক (প্রশিক্ষণ) প্রফেসর মোহাম্মদ শামছুল হুদাকে আহবায়ক, যশোর সরকারি এমএম কলেজের অধ্যক্ষ নমিতা রাণী বিশ্বাস ও যশোর সরকারি সিটি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবু তোরাব হাসানকে সদস্য করে তিন সদস্যের যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় ওই কমিটি মাদ্রাসাটি সরেজমিনে পরির্দর্শন শুরু করেন। এসময় প্রতিষ্ঠানের তদন্ত সংশি¬ষ্ট সকলের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য গ্রহন করেন এবং প্রয়োজনীয় দালিলিক কাগজপত্র যাচাই করেন।পরবর্তীতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে রক্ষিত তথ্যাদি যাচাই ও সংগ্রহ করা হয়। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
সরেজমিনে তদন্তকালে জাকারিয়া হোসেন (ইনডেক্স নং ৩৬৩১২৪) প্রথম নিয়োগের নিয়োগপত্র, নিয়োগের রেজুলেশন, নিয়োগ বাছাই কমিটির সুপারিশের রেজুলেশন, নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফল শীট, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও ডিজি মহোদয়ের প্রতিনিধি মনোনয়নের আদেশসহ নিয়োগ সংক্রান্ত অন্যান্য রেকর্ড ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি সরবরাহ করতে পারেননি জাকারিয়া হোসেন। তার সহকারী মৌলভী পদের মুল নিয়োগপত্র ও যোগদানপত্রের ফটোকপি আছে মাত্র। জাকারিয়া হোসেনের সরবরাহকৃত কাগজপত্র অনুযায়ী তার প্রভাষক আরবী পদে সমন্বয়/নিয়োগ বিষয়ে গভার্ণিং বডির সিদ্ধান্তের মূল কাগজপত্র নেই। জাকারিয়া হোসেন তার প্রভাষক আরবী পদে সমন্বয়/পদায়ন/ নিয়োগ সংক্রান্ত রেজুলেশন সরবরাহ করতে পারেননি। তার নিয়োগ/পদায়ন/সমন্বয় সংক্রান্ত কোন সিদ্ধান্তের বৈধতা নেই বলে তার সরবরাহকৃত কাগজপত্র অনুযায়ী তথ্য মিলেছে। এছাড়া ওই সংক্রান্তে নির্বাহী বডির সিদ্ধান্তের মূল কাগজপত্র নেই।
কমিটি প্রতিবেদনে পরিস্কার করেছে জাকারিয়া হোসেনের প্রভাষক আরবী পদের নিয়োগ সংক্রান্ত কোনপ্রকার মূল কাগজপত্র তদন্তকালে পাওয়া যায়নি। এ কারনে প্রভাষক আরবী পদে জাকারিয়া হোসেনের পদায়ন বৈধ হয়নি। ফলে প্রভাষক, আরবী পদে তার এমপিটিও সঠিক হয়নি। এছাড়া জাকারিয়া হোসেন ২০১৪ সালের ২৭ অক্টোবর অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার প্রভাষক আরবী পদে নিয়োগই বৈধ না হওয়ায় অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কোনো অভিজ্ঞতার শর্ত পূরণ হয়নি।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সিদ্ধান্তে এক যুগের অপতৎপরতার অবসান হয়েছে উপশহর আলিম মাদ্রাসার। অধ্যক্ষকে বাইরে রেখে অবৈধ অধ্যক্ষ জাকারিয়াকে নিয়োগ দিয়ে মাদ্রাসা শোষন করে লাখ লাখ টাকা পকেটস্থ করা চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি উঠেছে এলাকাবাসীর পক্ষে।
আরও পড়ুনঃ পুরান ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত বি.এম.সাগর
Leave a Reply