মুসলমানদের জীবনে শবে বরাত অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। শবে বরাত ফারসি শব্দ। শব মানে রাত, বরাত মানে মুক্তি; শবে বরাত অর্থ মুক্তির রাত। এর আরবি হলো- ‘লাইলাতুল বারাত।’ হাদিস শরিফে এ রাতকে ‘নিসফ শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্যরাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশে এ রাত শবে বরাত নামেই বেশি পরিচিত।
পবিত্র আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হা মীম! শপথ! স্পষ্ট কিতাবের, নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়।’ -সূরা আদ দুখান: আয়াত ১-৩।
আল কোরআনের তাফসির বীদগন ব্যাখা করে বলেন, এই আয়াতে ‘লাইলাতুম মোবারাকা’ বা বরকতময় রাত বলে শাবান মাসের পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। -তাফসিরে মাজহারি ও রূহুল বায়ান।
অন্যদিকে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত মোয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে নবী করিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে মাখলুকাতের দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ছাড়া আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। -সহিহ ইবনে হিব্বান: ৫৬৬৫
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু সালাবা (রা.) থেকে বর্ণিত, যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে, তখন আল্লাহতায়ালা মাখলুকাতের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান; মুমিনদের ক্ষমা করে দেন, কাফেরদের ফিরে আসার সুযোগ দেন এবং হিংসুকদের হিংসা পরিত্যাগ ছাড়া ক্ষমা করেন না। -কিতাবুস সুন্নাহ, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২
লাইলাতুল বরাতের বা শবে বরাতের গুরুত্ব ও ফজিলত
হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, একবার হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন যে আমার ধারণা হলো তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন; আমি তখন উঠে তার পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ল; তিনি সিজদা থেকে উঠলেন এবং নামাজ শেষ করে আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে আয়েশা! তোমার কি এ আশঙ্কা হয়েছে (মৃত্যুর)? আমি উত্তরে বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সা.), আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না। নবী করিম (সা.) বললেন, তুমি কি জানো এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলই ভালো জানেন। তখন নবী করিম (সা.) বললেন, এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত; এই রাতে আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন; ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করে দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের তাদের অবস্থাতেই ছেড়ে দেন। -শুয়াবুল ঈমান, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮২
হাদিসে আরও ইরশাদ হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, যখন শাবানের মধ্য দিবস আসবে, তখন তোমরা রাতে নফল ইবাদত করবে এবং দিনে নফল রোজা পালন করবে। -ইবনে মাজাহ
করণীয় বিষয় সমূহ:
ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নামাজ। আর নফল ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো নফল নামাজ।
এ ছাড়া প্রতি মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখ আইয়ামে বীজের নফল রোজা তো রয়েছেই। তা আমল করলে অনেক সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়।
শবে বরাত হলো- ইবাদত-বন্দেগির রাত। দান-খয়রাত করা ও মানুষকে খাওয়ানো একপ্রকার ইবাদত। তবে এ দিন ও রাতকে হালুয়া-রুটি খাওয়ার রাতে পরিণত করে ইবাদত ভুলে গিয়ে এসব কাজ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এই রাতকে নিজেকে পাপ ও দুনিয়া আখিরাতের পুঁজি হিসেবে তৈরি করে নেয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।
শবে বরাত উপলক্ষে নফল রোজা রাখা, নফল নামাজ পড়া, কেরাত ও রুকু-সিজদা দীর্ঘ করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, বেশি বেশি দরুদ শরিফ পাঠ করা, ইস্তিগফার অধিক পরিমাণে করা, ফজিলতপূর্ণ বিভিন্ন দোয়া, তাসবিহ-তাহলিল ও জিকির-আজকার করা ইত্যাদি ।
কবর জিয়ারত করা, তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করা, পিতা-মাতার জন্য, স্ত্রী সন্তানের জন্য, নিজের জন্য, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সব মুমিন-মুসলমানের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কামনা করা।
করণীয় বিষয় গুলোর মধ্যে অন্যতম:-
১. নফল ইবাদত:
নফল নামাজ পড়া (তাহাজ্জুদ, হাফিজদের জন্য কুরআন তিলাওয়াত)।
কুরআন তিলাওয়াত করা ও তা থেকে শিক্ষা নেওয়া।
২. তওবা ও ইস্তিগফার:
নিজের ও অন্যদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা।
কৃত পাপের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া।
৩. দোয়া করা:
নিজের, পরিবারের ও সমগ্র মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনায় দোয়া করা।
অসুস্থ, মৃত ও কষ্টে থাকা মানুষদের জন্য দোয়া করা।
৪. রোজা রাখা:
অনেকে ১৫ই শাবান রোজা রাখেন, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
৫। সদকা ও দান করা:
গরিব-দুঃখীদের সহায়তা করা।
মসজিদ-মাদ্রাসা বা সমাজের কল্যাণমূলক কাজে দান করা।
৬। সঠিক বিশ্বাস রাখা:
শবে বরাতকে কেবল ইবাদতের রাত হিসেবে গ্রহণ করা, বিদআত ও ভুল আকিদা থেকে দূরে থাকা।
বর্জনীয় বিষয়
শবে বরাতে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ইবাদত-বন্দেগি না করে অযথা ঘোরাঘুরি করা, অযাচিত আনন্দ-উল্লাস করা, বেহুদা কথাবার্তা ও বেপরোয়া আচরণ করা, অন্য কারও ইবাদতের বা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো, হালুয়া-রুটি বা খাবারদাবারের পেছনে বেশি সময় নষ্ট করা ও ইবাদতে উদাসীনতা করা উচিত নয়। এতে পাপ হতে মুক্তির চেয়ে গোনাহের কাজ হবে। তাই এসব কাজ করা সমীচীন নয়।
শবে বরাতের ত্যাগ বা বর্জনীয় :
১. কোনো বিদআত বা নতুন প্রচলিত কাজ করা:
আতশবাজি বা ফানুস ওড়ানো, গান-বাজনা বা অনর্থক আনন্দ আয়োজন করা।
শবে বরাতকে বিশেষ খাবারের রাত বানানো।
২. অহংকার ও কু-অভ্যাস ত্যাগ করা:
আল্লাহর কাছে বিনীত হওয়া, রিয়া বা লোক দেখানো ইবাদত না করা।
হারাম কাজ যেমন সুদ, ঘুষ, মিথ্যা, অন্যায়—এসব থেকে তওবা করা।
৩. নামাজ ও ইবাদত না করে রাত পার করা:
গল্পগুজব বা ফেসবুক-ইউটিউবে সময় নষ্ট না করা।
এই রাতকে শুধু আনন্দের রাত মনে না করে ইবাদতের মাধ্যমে কাটানো।
শবে বরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যেখানে আল্লাহর রহমত ও ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের উচিত এই রাতকে যথাযথভাবে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে কাটানো এবং বিদআত ও অনর্থক কাজ থেকে দূরে থাকা।
এছাড়া এই রাতকে কেন্দ্র করে অনেক মহিলা মাজারে যান ও নামাজ আদায় করেন। প্রকৃতপক্ষে মাজারে বা কবর জিয়ারত মহিলাদের নিষেধ করা হয়েছে। তবে পুরুষদের বেলায় নয়। তাই এসব থেকে বিরত হয়ে নিজ ঘরে ইবাদত বন্দেগি করা।
মহান আল্লাহ পাক উনার হাবীব মুহাম্মাদ মোস্তফা সঃ এর উছিলায় আমাদের ক্ষমা করুন এবং সঠিক ভাবে পূর্ণময় রাতে ও সবসময় আমল করার তৌফিক দান করুন। আল্লাহ পাক আমাদের বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন
লেখক
মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী
গবেষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
মুঠোফোন -০১৭৯৬-৪৬৩৪৮৫
ইমেইল – pressmuazzambd@gmail.com
মৌলভীবাজার, সিলেট, বাংলাদেশ।
Leave a Reply