
বেসরকারি এমপিওভূক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ২০% বাড়ি ভাড়া,১৫০০ টাকা চিকিৎসাভাতা ও কর্মচারীদের ৭৫% উৎসব ভাতার ন্যায্য এবং যুক্তিসঙ্গত দাবী নিয়ে ১২ই অক্টোবর থেকে ঢাকায় আন্দোলন চলছে।সারাদেশ থেকে লাখ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।
আন্দোলনরত শিক্ষক- কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের প্রথম দিনেই ফ্যাসিবাদী কায়দায় পুলিশের অতর্কিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত লাঠিচার্জ,সাউন্ড গ্রেণেড ও জল কামানের ব্যবহার অত্যন্ত দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়।তবে এতো কিছুর পরও আন্দোলনে ন্যুনতম ভাটা পড়েনি বরং আরও বেগবান হচ্ছে
ও অধিকতর উপস্থিতি ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রাম কখনো দমন-পীড়ন করে থামানো যায়না,যাবেও না।শিক্ষক-কর্মচারীদের উপর এই নৃশংস হামলার ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো সরকার,প্রশাসন ও পুলিশের ভিতর কোন পরিবর্তনই ঘটেনি।তবে কি এই রাষ্ট্র পুলিশি রাষ্ট্রই থেকে যাবে?আমরা কি একটা মানবিক রাষ্ট্র কখনোই পাবো না?একটি বৈষ্যমহীন মানবিক রাষ্ট্রের প্রত্যাশায় জুলাই বিপ্লবে এতো প্রাণ ঝরে গেলো,
এতো রক্তক্ষয় আর স্বৈরাচারের পতন সবই কি তবে বৃথা?শিক্ষককে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা,হাতে হাতকড়া পড়িয়ে জামার কলার চেপে টেনেহিঁচড়ে অপদস্ত করা কোন সভ্য রাষ্ট্রের কাজ হতে পারে না।শিক্ষক-কর্মচারীরা তো সরকারের ক্ষমতার মসনদের ভাগিদার হওয়ার জন্য,আমলাদের পাতের ভাত কেড়ে নেওয়ার জন্য ঢাকায় আন্দোলন করতে যায়নি,তবে কেন তাদের উপর এই বর্বরোচিত হামলা করা হলো?
এই রাষ্ট্র ও দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা কখনো ভেবে দেখেছেন কি ১২,৫০০ কিংবা ৮,২০০ টাকায় একজন শিক্ষক- কর্মচারীর সংসার কিভাবে চলে,একবারও ভেবে দেখেছেন ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতায় একটি শিক্ষক-কর্মচারী পরিবারের কতটুকু চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হয়,আপনারা বলতে পারবেন কি ১০০০ টাকায় কোথায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়?
উৎসব ভাতার কথা আর নাই বলি।লক্ষ টাকা বেতনের একজন সচিব কে যে টাকায় বাজারে গিয়ে এককেজি আলু-পটল কিনতে হয় ১২৫০০ কিংবা ৮২০০টাকা বেতনের একজন শিক্ষক- কর্মচারীকেও সেই একই মূল্য দিতে হয় বাজার করতে।একজন সরকারি শিক্ষক যে যোগ্যতা নিয়ে,যে সিলেবাসে পাঠদান করান,সেই একই যোগ্যতায় একই সিলেবাসে একজন বেসরকারি শিক্ষকও পাঠদান করান কিন্তু এ দু’য়ের বেতন-ভাতায় বিস্তর বৈষম্য।আপনারা বলবেন কি কেন এই বেতন বৈষম্য?দেশ এক অথচ নীতি ভিন্ন।
নিজেদের ন্যায্য পাওনা আর পেশাগত মর্যাদা আদায়ের আন্দোলনে আজকে ঢাকায় যখন আন্দোলনকারী শিক্ষক -কর্মচারীরা মার খাচ্ছেন, রক্ত ঝরাচ্ছেন,তখন একদল তথাকথিত সুশীল আর সুবিধাভোগীরা শিক্ষকদের নীতি- নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন,প্রশ্ন তুলছেন শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে আমরা কেন রাজপথে?প্রশ্ন তো আমাদেরও,কেন আমরা রাজপথে নামতে বাধ্য হলাম?লাখ টাকা বেতন,উন্নত গাড়ি- বাড়িসহ প্রয়োজনের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত হওয়ার পরেও রাষ্ট্রের কর্তা ব্যক্তিরা যখন আকাশছোঁয়া ঘুষ- দূর্নীতিতে নিমজ্জিত থাকে,তখন আপনাদের এই সুশীলতার মুখ কেন মুখোশে ঢাকা থাকে?
আপনাদের সকল নীতিবাক্য আর আদর্শের তীর কেবল এই বেসরকারি শিক্ষক- কর্মচারীদের বেলায় যাদের জীবনধারনের ন্যূনতম নিরাপদ ব্যবস্থা স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও এই রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে পারেনি।
একজন বেসরকারি শিক্ষকের মাসিক সর্বনিম্ন বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা,১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া আর মাত্র ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা,যেখানে একজন সচিব কেবল গাড়ি রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য মাসে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাতা পান।ভেবেছেন কি যেখানে একজন ডাক্তারের নুন্যতম ভিজিট ১হাজার টাকা,সেখানে পুরো পরিবারের জন্য মাসিক পাঁচশত টাকা চিকিৎসা ভাতা কতটা নির্মম পরিহাস?
আপনারা হয়তো বলবেন,শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়িয়ে বাড়তি উপার্জন করেন।হ্যাঁ,পড়ান।
এদেশে ইংরেজি আর বিজ্ঞান বিভাগ মিলিয়ে হয়তো শতকরা দশ-পনেরো ভাগ শিক্ষক প্রাইভেট কিংবা কোচিং ব্যবসায় জড়িত অথচ এটাকেই শিক্ষা ধ্বংসের মূল প্রতিপাদ্য প্রমাণে এদেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আর সুশীল- কুশীলদের গলদঘর্ম অবস্থা।
আপনাদের মনে কি একবারও এই প্রশ্ন উদিত হয়না,কেন একজন ডাক্তার পর্যাপ্ত বেতন- ভাতা,উন্নত আবাসন ব্যবস্থা পাওয়ার পরও প্রাকটিসের নামে হাজার টাকা ফী’র বিনিময়ে বাইরে রোগী দেখেন?কখনও কি ভেবে দেখেছেন একজন আমলা কেন সর্বোচ্চ জীবনমান নিশ্চিত হওয়ার পরও নানা অজুহাতে অনিয়ম- দূর্নীতি করে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ বাণিজ্যের সাথে জড়িত হয়?জানি এসব প্রশ্ন কখনো আপনাদের তাড়িত করেনা,কারণ যেসব কামলাদের শ্রমে-ঘামে ঐসব আমলাদের অন্ন,বস্ত্র,চিকিৎসা ও বাসস্থান নিশ্চিত হয় তারা কখনও এসব নিয়ে ভাববার অবকাশই পান না।
তবে কি তাদের ত্বত্ত্ব এই যে,”গাঙ পেরুলে মাঝি ত্যাজ্য”।
ছোট বেলায় পড়েছিলাম কিংবা শুনেছিলাম যে, আসামের এক লাট সাহেব তার তিন ঠ্যাঙওয়ালা একটি কুকুর সঙ্গে নিয়ে একটি স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন।তিন ঠেঙে সেই কুকুরের পেছনে মাসে খরচ হতো পঁচাত্তর টাকা আর সেই স্কুলের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পন্ডিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ছিলো পঁচিশ টাকা, যার উপর দায়িত্ব ছিলো পরিবারের আট সদস্যের ভরণপোষণের।সেদিন হতভাগ্য সেই পন্ডিত মশাই অপমানে, রাগে-ক্ষোভে তাঁর ক্লাস ভর্তি ছাত্রদের প্রশ্ন করেছিলেন,”তার আট সদস্যের পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?”
স্বাধীনতার চুয়ান্ন বছর পার হতে চললো অথচ এখনও দরিদ্র পন্ডিত মশাইয়ের সেই হৃদয় বিদারক প্রশ্নই এদেশের বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি মূহুর্ত তাড়িয়ে বেড়ায়।
প্রদীপের নিচে অন্ধকারের মতো দেশ গড়ার কারিগরদের একটা বৃহৎ অংশকে বছরের পর বছর অবজ্ঞা- অবহেলায়, অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে একটি স্মার্ট জাতি ও দেশ গঠনের স্বপ্ন,দুঃস্বপ্ন বৈ আর কিছু নয়।
আজকে শিক্ষকদের অপমানে, শিক্ষকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখেও যাদের বোধদয় হয়না তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা ও ধিক্কার জানাই।
মোঃ মাহবুবুর রশীদ মন্ডল
অধ্যক্ষ
চর রাজিবপুর বিএম কলেজ।
১৬-১০-২০২৫ খ্রিঃ
Leave a Reply