মোঃ আব্দুস সামাদ প্রতিনিধি:খাল শুকিয়ে প্রায় পানিশূন্য। সেই খালে বাধ দিয়ে ও স্থাপনা তৈরি করে অবাধে চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই খালের অস্তিত্ব। কোথাও পাড় ঘেঁষে আবার কোথাও মাঝে পিলার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কেউ মাছ চাষ করতে দিয়েছেন বাধ।
কেউ জমি দখল করে কেটেছেন পুকুর। এক সময়ের খরস্রোতা এসব খাল এখন মানুষের দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে। পানি প্রবাহেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদনও। ঝিনাইদহের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্যই দেখা গেছে।
জেলার শৈলকুপা উপজেলার নিত্যানন্দনপুর বাঁওড়ের সঙ্গে সংযুক্ত ভবানীপুর থেকে সদরের বাকড়ি বাজার সংলগ্ন নবগঙ্গা নদীতে মিশেছে একটি খাল। এটি বিভিন্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাঁওড়ে মাছ চাষের জন্য নিত্যানন্দনপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক মফিজুল ইসলামসহ অন্যরা তিন বছর আগে বাঁধ নির্মাণ করেন।
এতে পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। বাকড়ি বাজার এলাকায় নবগঙ্গা নদীর পাশে ২০ বছর আগে শাহেদ জোয়ারদার নামে এক ব্যক্তি খালের জমি দখল করে দুটি বড় পুকুর কাটেন। তাঁর মৃত্যুর পর পুকুর দুটি ভোগদখল করছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও হরিশংকরপুর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খোন্দকার ফারুকুজ্জামান ফরিদ। অবশ্য ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক।
জেলার বিভিন্ন অংশে এভাবে সরকারি খাল দখল হয়ে যাওয়ায় সেচ ও পানি নিষ্কাশনে বড় ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে ব্যাহত হচ্ছে ফসল উৎপাদনও। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২১৪টি সেচ খাল ও ১৪২টি পানি নিষ্কাশন খাল রয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৯৬৮ কিলোমিটার। প্রতিটি খালের দু’পাশে ৫০ থেকে ১২০ ফুট সরকারি জমি রয়েছে। বাস্তবে অন্তত ৯০ শতাংশ খালের পাড় নানাভাবে দখল হয়ে গেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সরেজমিন হরিণাকুন্ডুর কুলবাড়িয়া বাজার ও আশপাশের এলাকায়
খাল শুকিয়ে প্রায় পানিশূন্য। সেই খালে বাধ দিয়ে ও স্থাপনা তৈরি করে অবাধে চলছে দখলের প্রতিযোগিতা। দূর থেকে বোঝার উপায় নেই খালের অস্তিত্ব। কোথাও পাড় ঘেঁষে আবার কোথাও মাঝে পিলার দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। কেউ মাছ চাষ করতে দিয়েছেন বাধ। কেউ জমি দখল করে কেটেছেন পুকুর। এক সময়ের খরস্রোতা এসব খাল এখন মানুষের দখলে অস্তিত্ব হারিয়েছে
গিয়ে খাল দখলের নানান চিত্র পাওয়া গেছে। বাজার ও আশপাশের এলাকায় সেচ খালের দু’পাশে গড়ে উঠেছে শতাধিক কাঁচা-পাকা ও আধা পাকা ঘর। কুলবাড়িয়া বাজারের দোকানি সাজেদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘খালপাড়ের দোকানগুলো বহু বছর আগে তৈরি করা। দখলদারদের অধিকাংশই দোকান ভাড়া দিয়ে রেখেছেন। অনেকে নিজে ব্যবসা করেন না।’
উপজেলার শাখারীদহ বাজার এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি নিষ্কাশন খালের দু’ধারে ও ভেতরে সারিবদ্ধভাবে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা-আধা পাকা অসংখ্য স্থাপনা। প্রায় ২৫ বছরের বেশি সময় এভাবে বাজারের আশপাশে চলছে দখলদারিত্ব। স্থানীয় লোকজন বলছেন, একজনের দেখাদেখি একে একে এমন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন
এলাকার প্রভাবশালী ও খালপাড়ের মানুষ। শাখারীদহ বাজারে সরকারি জমি দখল করে পাকা দোকান গড়ে তুলেছেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাজারে জায়গা কম তাই দোকান নির্মাণ করেছি। পাউবোর মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করে রেখেছি, যদি কখনও ইজারা পাওয়া যায়।’ আরেক দোকানি আব্দুল হোসেন শেখ বলেন,
‘অন্যরা করেছে, তাই দেখাদেখি আমিও পাকা দোকান করছি।’ ২০২২ সালে হরিণাকুণ্ডু উপজেলার সাত ব্রিজ, শৈলকুপার কাতলাগাড়ী বাজার এবং ২০২১ সালে কোটচাঁদপুর এলাকার কয়েকটি খালে শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে পাউবো। এর পরও এসব খালের ধারে প্রায় দুই হাজারের বেশি দখলদার রয়েছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। পাউবো জানিয়েছে, জেলার বিভিন্ন স্থানে খালের পাশে ৭ হাজার ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা আছে।
এর মধ্যে ২ হাজার একর জমিই দখল হয়ে গেছে। স্থানীয় ভবানীপুর গ্রামের কৃষক অমরেশ কুমার রায় বলেন, ‘মাছ চাষের সুবিধার্থে বাঁওড়ের ধারে আওয়ামী লীগের নেতারা বাঁধ দেওয়ার ফলে ঠিকমতো বাঁওড় ও মাঠের পানি নিষ্কাশন হয় না। ফলে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।’ সদর উপজেলার পরানপুর গ্রামের বাসিন্দা সাইফুল উদ্দিন বিশ্বাসের ভাষ্য, ‘সরকারি খালের জমিতে কেউ পুকুর তৈরি করছেন, কেউ স্থাপনা তৈরি করছেন।
এগুলো উচ্ছেদ করা জরুরি। স্থাপনা ও বাঁধের কারণে পানি নিষ্কাশন হয় না, সেচ সুবিধাও পাওয়া যায় না।’
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দখলের মাত্রা কয়েক গুণ বেড়েছে বলে জানান ঝিনাইদহ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্য আমিনুর রহমান টুকু। তিনি বলেন, ‘দখলের বিরুদ্ধে স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষসহ সবাইকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এর সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উচ্ছেদ অভিযানও অব্যাহত রাখতে হবে।’ এ বিষয়ে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, ‘লোকবল সংকটসহ নানা কারণে উচ্ছেদ অভিযানে কিছুটা সমস্যা হয়। বেশ কিছু এলাকায় দখলদারের তালিকা করা হয়েছে। অচিরে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হবে।
Leave a Reply