নড়াইল প্রতিনিধিঃ ভাটার সময় যাত্রা শুরু। ভাটায় ৬ ঘন্টা চলার পর জোয়ার আসলে নদীর তীরে ৬ ঘন্টা বাঁশ বেঁধে রাখতে হয়।
পূনরায় ভাটা আসলে আবার যাত্রা শুরু। এভাবে বাঁশ নিয়ে কমপক্ষে ৫০ মাইল ১৬টি জোয়ার-ভাটা অতিক্রম করে টানা দুই দিনে খুলনায় পৌছান। এ’কদিন নদীর মধ্যে খাওয়া, ঘুমানোসহ নিত্যদিনের সব কিছুই করতে হয়। প্রতি চালানে মালিক পক্ষ দূরত্ব অনুযায়ী বাঁশ প্রতি ৫-১০ টাকা দেয়।
এক এক চালানে (প্রতি ট্রিপে) গড়ে ৭ শ থেকে ২ হাজার পিচ বাঁশ থাকে। এ কাজে তেমন কোনো ঝুঁকি না থাকলেও অনেক সময় রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে গন্তব্যস্থলে যেতে হয়। এ ছাড়া যাওয়ার সময় যাতে কোনো ট্রলার, কার্গো বা লঞ্চে আঘাত না লাগে সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। এ কথাগুলো বললেন সদরের চন্ডিবরপুর ইউনিয়নের ফেদি গ্রামের বাদশা মিয়া, চালিতাতলা গ্রামের টুলু মোল্যা ও মহিষখোলা গ্রামের বাবু শেখ।
তারা বলেন, ২০ বছর ধরে এ পেশার সাথে জড়িত। আমাদের জীবনটা জোয়ার-ভাটার সাথে বাঁধা। শতাধিক মানুষ এ পদ্ধতির সাহায্যে খুলনায় বাঁশ বহনের সাথে জড়িত বলে জানান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নড়াইলের মাটি বাঁশ উৎপাদনের জন্য বেশ উপযোগি। এখানে তল্লা, ভালকো ও কুড়য়া বাঁশ বেশী । ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে জেলায় ২৯১ হেক্টরে ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৪ পিচ বাঁশ উৎপাদন হয়। ২৪-২৫ অর্থ বছরে ২৯৬ হেক্টর জমিতে ১৭ লাখ ৩১ হাজার ৬৭০ পিচ বাঁশ উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে।
নড়াইলের বাঁশগ্রাম, চাঁচুড়ী, পলইডাঙ্গা, সীমানন্দপুর, ভুমুরদিয়া,চন্দ্রপুর, চৌগাছা, তুলারামপুর, নলদী, রায়খালি, ফেদী, চাপুলিয়া, পাইকমারি, রতডাঙ্গা, আউড়িয়া, এড়েন্দা, বল্লারটোপ, ভবানিপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় বাঁশের হাট গড়ে উঠেছে। এসব বাজারের অধিকাংশই নবগঙ্গা ও চিত্রা নদীর তীরে অবস্থিত। স্থানীয়রা জানান, ২০টি বাঁশ বিক্রির হাট থেকে প্রায় ১৫ শ শ্রমিকের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
সদরের ভদ্রবিলা ইউনিয়নের পলইডাঙ্গা গ্রামে চিত্রা নদীর পাড়ে প্রায় ১২ একর জায়গা নিয়ে বসেছে বৃহৎ বাশেঁর হাট। এখানে প্রতি রোববার ১০-২০ লাখ টাকার বাশঁ কেনাবেচা হয়ে থাকে। যশোর,খুলনাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ধশত ব্যাপারি এ হাটে আসেন বাঁশ ক্রয়ের জন্য। এখানে প্রায় দেড়’শ শ্রমিক ট্রলার, নৌকা বা জোয়ার-ভাটার মাধ্যমে বহনের জন্য কাজ করছে।
স্থানীয় শ্রমিক রহমান ফকির জানায়, দুর-দুরান্ত থেকে আসা বাশঁ পরিবহন থেকে নামানো এবং বাশেঁর ভুর (স্তুপ) সাজানোর কাজ থেকে এক একজন শ্রমিক দিনে ৩৫০ থেকে ৫০০ টাকা রোজগার করে।
খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা থেকে আসা ব্যবসায়ী হোসেন ব্যাপারি জানান, ১২ বছর ধরে এই হাট থেকে পাইকারি বাশঁ কিনে নিয়ে নদীপথে ট্রলারে অথবা জোয়ার-ভাটার সাহায্যে খুলনায় নিয়ে যাই। সেখান থেকে খুলনা,বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় নিয়ে বিক্রি করি । পানিপথে পরিবহন ব্যয় কম হওয়ায় লাভও বেশী হয়। প্রতিটা বাশঁ এখন সর্বনিম্ন ১শ ২৫ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৩শ টাকায় পাইকারি ক্রয় করি।
আকার ভেদে প্রতিটা বাশঁ খুলনায় ২শ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। নদী পথে বহন সহজ, ঝুঁকিমুক্ত ও পরিবহন ব্যয় কম হওয়ায় সময়সাপেক্ষ হলেও আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী নদী পথে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বাঁশ বহন করে থাকে।
ভদ্রবিলা ইউনিয়নের পলইডাঙ্গা গ্রামের সেন্টু কাজী বলেন, প্রতি রোববারে পলইডাঙ্গা গ্রামে একটি উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। বাঁশ উঠানো-নামানো এবং বিভিন্ন ঝাড় থেকে বাঁশ কাটার কাজ করে সবাই কমবেশী প্রতিদিন ৫শ থেকে ৮শ টাকা আয় করে থাকে। আবার স্থানীয় আকুব্বর শেখ,মফিজুর খান,শহিদুল খানসহ হবখালী,শরসুনা,পেড়লীসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২০ জন নদী পথে খুলনার বিভিন্ন ঘাটে এসব বাঁশ নিয়ে যায়।
সেখানে দূরত্ব অনুযায়ী মালিক পক্ষ তাদের বাঁশ প্রতি ৫-১০ টাকা দেয়। এখান থেকে তাদের একটি ভালো উপার্জন হয়। নড়াইল কৃষি সম্প্রসরণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোঃ জসীম উদ্দীন জানান, নড়াইল একটি উঁচু জেলা এবং এখানকার মাটি বাশঁ চাষের জন্য বেশ উপযুক্ত।
এ কারণে এখানে প্রচুর পরিমানে বিভিন্ন প্রজাতির বাশঁ উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে তা অপরিকল্পিতভাবে চাষ হচ্ছে। চাষিরা যাতে পরিকল্পিতভাবে চাষ করে সেজন্য আমাদের কৃষি কমকর্তারা কাজ করছেন। নড়াইলের চাহিদা মিটিয়ে অনেক বাঁশ খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় যায়। দেশের সর্বত্র গৃহ নির্মাণ সামগ্রির কাজ ছাড়াও পানের বরজ ও সবজি চাষে মাচাঙ তৈরি, জেলেদের মাছ ধরার সরঞ্জাম, হস্ত শিল্প তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে বাঁশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে রয়েছে বলে জানান।
আরও পড়ুন টিসিবির পণ্য মোড়ক বদলে বিক্রি করায় নড়াইলে দোকানিকে জরিমানা
Leave a Reply