মোফাসেরুল হক তন্ময়ঃ
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) তার ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করছে এবং ২৪তম বর্ষে পদার্পণ করছে। দক্ষিণাঞ্চলের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রসারে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই বিশেষ মুহূর্তে, পবিপ্রবির ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৯-৮০ শিক্ষাবর্ষে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ হিসেবে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহের অধিভুক্ত এই কলেজটি স্নাতক পর্যায়ে কৃষি শিক্ষাদান করত।
পরবর্তীতে, ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ বিলুপ্ত করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয় এবং ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে।
ক্যাম্পাস ও অবকাঠামো
পবিপ্রবির মূল ক্যাম্পাস পটুয়াখালী জেলার দুমকি উপজেলায় অবস্থিত, যা পটুয়াখালী শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে। ৯৭ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই ক্যাম্পাসে রয়েছে ৩৭ একর জমির একটি বিশাল কৃষি গবেষণা খামার।
একাডেমিক ভবনের সামনে সুদীর্ঘ লেক, আধুনিক ডিজাইনের ছাত্র ও ছাত্রী হোস্টেল, মসজিদ, স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং লাইব্রেরি ভবনসহ বিভিন্ন সুবিধা বিদ্যমান। এছাড়া, বরিশাল জেলার খানপুরা, বাবুগঞ্জে ১২.৯৭ একর জমির ওপর একটি আউট ক্যাম্পাস রয়েছে।
শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়ন
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পবিপ্রবি শিক্ষা ও গবেষণার মানোন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের মাধ্যমে বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এ পর্যন্ত ৮০১টি গবেষণা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০২২-২৩ সালে নিজস্ব ও সরকারি অর্থায়নে ১৫৩টি প্রকল্প পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণার মাধ্যমে পবিপ্রবি বেশ কয়েকটি উন্নত ও উচ্চফলনশীল ফলের জাত উদ্ভাবন করেছে, যেমন পিএসটিইউ বিলাতি গাব-১ ও ২, পিএসটিইউ ডেউয়া-১ ও ২, পিএসটিইউ বাতাবিলেবু-১, পিএসটিইউ কামরাঙা-১ ও ২, পিএসটিইউ তেঁতুল-১ এবং পিএসটিইউ বৈচি-১। এছাড়া, উপকূলীয় এলাকার জন্য উন্নত ক্রপিং সিস্টেম ও বায়োচার প্রযুক্তি উদ্ভাবন, দেশি জাতের ধানের সংগ্রহশালা তৈরি, ভুট্টা ও সূর্যমুখী চাষে স্ট্রিপ পদ্ধতি প্রবর্তন এবং লবণাক্ততা ও পানিসহিষ্ণু ধান উৎপাদনের প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্য।
শিক্ষার মানোন্নয়নে পবিপ্রবি আমেরিকান কোর্স ক্রেডিট সিস্টেম পদ্ধতি চালু করেছে। হাতে-কলমে শিক্ষাদানের জন্য এখানে ৩২টি আধুনিক গবেষণাগার এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জামসমৃদ্ধ একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগার রয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কোর্স কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন এনে আউটকাম বেইজড কারিকুলাম চালু করা হয়েছে। একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে শতভাগ ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সহশিক্ষা কার্যক্রম ও ডিজিটাল ক্যাম্পাস
পবিপ্রবিতে নিয়মিতভাবে বার্ষিক ক্রীড়া ও আন্তঃঅনুষদীয় টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতিচর্চার জন্য রয়েছে কয়েকটি সংগঠন ও গানের দল। এছাড়া, টিএসসি কেন্দ্রিক অর্ধশতাধিক সামাজিক সংগঠন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ডিজিটাল ক্যাম্পাসে পরিণত করার কাজ চলছে। লাইব্রেরিকে শতভাগ ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া, শিক্ষার্থী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ডিজিটাল পরিচয়পত্র প্রদান, হোস্টেলসহ সবখানে হাইস্পিড ওয়াই-ফাই ইন্টারনেট সংযোগ এবং পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে অটোমেশন করার কাজ চলমান।
অবকাঠামো উন্নয়ন ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা
অবকাঠামো উন্নয়ন
বর্তমানে, পবিপ্রবি প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নিম্নে তুলে ধরা হলো:
ভূমি উন্নয়ন ও খামার ভবনের সম্প্রসারণ: ৪ তলা খামার ভবনের আনুভূমিক সম্প্রসারণের মাধ্যমে গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ করা হচ্ছে।
প্রশাসনিক ভবনের উন্নয়ন: প্রশাসনিক কার্যক্রমকে আরও সুসংগঠিত করতে ৫ তলা বিশিষ্ট নতুন সিঁড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে।
ছাত্রাবাস নির্মাণ: শিক্ষার্থীদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১০ তলা বিশিষ্ট তাপসী রাবেয়া
ও শেরে ই বাংলা হল নির্মাণাধীন।
একাডেমিক ভবন নির্মাণ: শিক্ষা কার্যক্রমের সম্প্রসারণে ১০ তলা ও ৬ তলা বিশিষ্ট দুটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে।
অন্যান্য সুবিধা: কবি বেগম সুফিয়া কামাল হলের সম্প্রসারণ, ২ তলা আনসার ব্যারাক ভবন, আবহাওয়া স্টেশন ভবন, ২ তলা উপাচার্যের বাসভবন, বিদ্যমান ইউনিভার্সিটি স্কুল ও কলেজের ৪ তলা পর্যন্ত সম্প্রসারণ, ১০ তলা অধ্যাপক ও সমমানের কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন, ৫ তলা সহকারী অধ্যাপক ও সমমানের কর্মকর্তাদের ভবন, মুক্তমঞ্চ, মিনি স্টেডিয়াম, আধুনিক ব্যায়ামাগার এবং সবুজ বেষ্টনীবিশিষ্ট প্রাচীর নির্মাণসহ নানাবিধ অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা
পবিপ্রবি তার ভবিষ্যত পরিকল্পনায় একাডেমিক ও ফিজিক্যাল মাস্টারপ্লান তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উল্লেখযোগ্য ভবিষ্যত পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে:
মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন: সমুদ্র সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও গবেষণার জন্য কুয়াকাটায় ৬০০ কোটি টাকার ডিপিপি জমা দেওয়া হয়েছে।
ফিজিক্যাল মাস্টারপ্লান তৈরি: মূল ক্যাম্পাস, বাবুগঞ্জস্থ এএনএসভিএম অনুষদ এবং কুয়াকাটায় প্রস্তাবিত মেরিন ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত করে ফিজিক্যাল মাস্টারপ্লান তৈরি করার জন্য একটি ডিপিপি তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এএনএসভিএম অনুষদের আধুনিকায়ন: প্রায় ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে, যেখানে একটি কেন্দ্রীয় গবেষণাগারসহ অ্যানিমেল রিসার্চ ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
কেন্দ্রীয় গবেষণাগার স্থাপন: মূল ক্যাম্পাসেও আধুনিক কেন্দ্রীয় গবেষণাগার স্থাপনের জন্য ডিপিপি তৈরি করা হচ্ছে, যেখানে আধুনিক গবেষণাসহ পায়রা সমুদ্র বন্দর দিয়ে আমদানিকৃত সকল কৃষি পণ্যের গুণাবলী পরীক্ষা করা হবে।
নতুন বিভাগ খোলা: ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ইইই বিভাগ, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, কৃষি প্রকৌশল বিভাগ ও বায়োমেডিকেল বিভাগসহ অন্যান্য যুগোপযোগী বিভাগ খোলার পরিকল্পনা রয়েছে।
২৩ তম বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উপলক্ষে মাননীয় উপচার্য ও উপ-উপাচার্য বাণী দিয়েছেন।
উপাচার্যের বাণী
পবিপ্রবির উপাচার্য ড. কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, “২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আমাদের জন্য একটি মাইলফলক। আমরা শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণার প্রসার এবং সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভবিষ্যতে আমরা আরও উচ্চতর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাব।”
উপ-উপাচার্যের বাণী
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস.এম হেমায়েত জাহান বলেন, “পবিপ্রবি তার শিক্ষার গুণগত মান ও গবেষণার জন্য সুপরিচিত। আমরা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আগামী দিনে আমরা আরও নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করব।
২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ২৪তম বর্ষে পদার্পণ উপলক্ষে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষার মান, গবেষণা ও সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পবিপ্রবি আগামী দিনে আরও সাফল্যের শিখরে পৌঁছাবে।
Leave a Reply